ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছয় উপজেলায় সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ 

পাহাড়ে দু'দিনে তিন ব্যাংক লুট, দেশজুড়ে উদ্বেগ 

হামলায় অংশ নেয় শতাধিক অস্ত্রধারী, গায়ে ছিল কেএনএফের পোশাক
পাহাড়ে দু'দিনে তিন ব্যাংক লুট, দেশজুড়ে উদ্বেগ 

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে পৃথক ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার দুপুরে পৃথক সময়ে এই ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটে। টাকার পাশাপাশি লুট করা হয়েছে ১৪টি অস্ত্রও। এছাড়া একজন ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণ করা হয়েছে। গত দু'দিনে তিন ব্যাংক লুটের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাংক পাড়া গুলোতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

এদিকে বুধবার সকাল থেকে বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকের ছয়টি উপজেলার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের এজিএম ওসমান গনি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, থানচি ও রুমায় ব্যাংক ডাকাতি হওয়ার পর নিরাপত্তার স্বার্থে রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সব ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। টানা দুদিনের ব্যাংকে হামলায় বান্দরবানজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশের টহল বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোড়দার করা হয়েছে

সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা ও ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে তুলে নিয়ে যায়।

সোনালী ব্যাংক বান্দরবান অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক (এজিএম) মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, সোনালী ব্যাংক রুমা শাখায় ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে। রুমা শাখায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা থাকার কথা। সেগুলো ভল্ট ভেঙে নিয়ে গেছে। এই ঘটনার পর এ অঞ্চলের ব্যাংকের সব শাখায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৯টার দিকে কেএনএফের ৭০ থেকে ৮০ জন সশস্ত্র সদস্য রুমা উপজেলা পরিষদ এলাকা ঘেরাও করে। তারা সোনালী ব্যাংকে গিয়ে পাহারারত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং মারধর করতে থাকে। ব্যাংকে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।

রুমার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিদারুল আলম বলেন, কেএনএফের সদস্যরা সোনালী ব্যাংক রুমা শাখা লুটপাট করেছে। ব্যাংকের পাহারারত পুলিশ-আনসার সদস্যদের চারটি হাতিয়ার লুট করে নিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, কেএনএফ সন্ত্রাসীরা মসজিদে মুসল্লিদেরও মারধর করে তাঁদের মুঠোফোনও নিয়ে গেছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিনকে সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনার পর উপজেলা পরিষদ এলাকায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, কেএনএফের সদস্যরা ৮টি চায়নিজ রাইফেল, দুইটি এসএমজি, ৪টি শটগান ও ৪১৫টি গুলি লুট করে নিয়ে গেছে। তাদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের এক কর্মচারী আহত হয়েছেন।

অপরদিকে থানচি উপজেলা শহরের সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি হয়েছে। বুধবার বেলা একটার দিকে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। থানচি সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অং প্রু ম্রো বলেন, বেলা একটার দিকে থানচি সদরের শাহজাহানপুরের দিক থেকে তিনটি চাঁদের গাড়িতে করে সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে বাজার এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর থানচি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে নগদ টাকা যা পেয়েছে তা নিয়ে চলে যায়। এরপর তারা আবার ওই তিন গাড়িতে করে শাহজাহানপুরের দিকে চলে।

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন জানান, সোনালী ও কৃষি ব্যাংক লুট হয়েছে। তবে টাকার পরিমাণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফাঁকা গুলিবর্ষণ ও বাজারের লোকজনের কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা।

#মামলা হয়নি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি ও ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুটের ১৪ ঘণ্টা পার হলেও মামলা হয়নি। তবে এই ঘটনায় বুধবার (৩ এপ্রিল) সকালে জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় রুমা মসজিদে তারাবি নামাজ পড়ার সময় একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী মসজিদের সবাইকে জিম্মি করে সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার কে জানতে চায়। এক পর্যায়ে ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে সঙ্গে করে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে গেইট ভেঙে অফিসে থাকা সরঞ্জাম নষ্ট করে ফেলে এবং ব্যাংক নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে কার্তুজসহ মোট ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়।

রুমা সোনালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার উথোয়াইচিং মারমা জানান, ডরমিটরির বাইরে চায়ের দোকানে চা খেতে গেলে মুখে কালি লাগানো অপরিচিত ৩ জন লোক অস্ত্রের মুখে দাঁড় করায় এবং তার শরীরে তল্লাশি চালিয়ে পকেটে থাকা ১৫শ টাকা ও ব্যাংকের চাবি নিয়ে নেয়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী আসার পর ব্যাংকে গিয়ে দেখেন অফিস সরঞ্জাম সব ছড়ানো ছিটানো রয়েছে। তার জানামতে ভল্টের ভেতর ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জমা ছিল। ভল্টের দুইটি চাবির মধ্যে তার কাছে ১টি এবং অপহরণের শিকার ম্যানেজারের কাছে অপরটি থাকে। ভল্ট না খোলা পর্যন্ত টাকা লুটের বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাজাহান জানান, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মামলা হয়নি।

পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, পুলিশের ৮টি চায়না রাইফেল, ২টি এসএমজিসহ ১০টি অস্ত্র ও ৩৮০ রাউন্ড গুলি, আনসারের ৪টি শর্টগান, ৩৫ রাউন্ড গুলিসহ ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে সন্ত্রাসীরা। তবে কে বা কারা করেছে ক্রাইমটিম আসলে তারা ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে তদন্ত করবে। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে, কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আবদুল করিম বলেন, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে কেএনএফের প্রায় ১০০ অস্ত্রধারী সদস্য এই হামলায় অংশ নিয়েছে। হামলাকারী অনেকের গায়ে কেএনএফের লোগোসহ পোশাক ছিল। হামলার শুরুতে সন্ত্রাসীরা উপজেলা পরিষদের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে অস্ত্র ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়।

তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার ম্যানেজার মো. নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করা হয়েছে। গত ১৬ ঘণ্টা ধরে অভিযান পরিচালনা করেও তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, সোনালী ব্যাংকের ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ, ব্যাংকের ভল্ট চেক করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রাইমসিন টিম আসলেই বোঝা যাবে টাকা খোয়া গেছে কিনা? ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করার জন্য পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আফজাল করিম বলেন, সোনালী ব্যাংকের থানচি শাখায় হামলার খবর পেয়েছি। পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গেছে। তারা কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, এর আগে মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বান্দরবানের রুমায় নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সোনালী ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা ও ১৪টি অস্ত্র লুট করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।

রুমা উপজেলা পরিষদ উপজেলা শহর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে বেথেলপাড়ার কাছাকাছি। বেথেলপাড়ায় গত ৫ মার্চ কেএনএফের সঙ্গে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে কেএনএফ আর সন্ত্রাসী তৎপরতা না চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ওই বৈঠকের পরও রুমা উপজেলা সদরসংলগ্ন বম জনগোষ্ঠীর বেথেলপাড়া, মুনলাইপাড়া, এডেনপাড়াসহ বিভিন্ন পাড়ায় কেএনএফের সদস্যরা আশ্রয় নিয়ে ছিল।

বান্দরবানে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে তৎপরতা শুরু করে। পাহাড়ে তাদের আস্তানায় সমতলের নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সদস্যরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতিপূর্বে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল।

সেই আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছর অভিযান চালিয়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া ও কেএনএফের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ কমিটি গঠন করা হয় গত বছরের মে মাসে। ওই কমিটির সঙ্গে ৫ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয় বেথেলপাড়ায়।

বান্দরবান
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত